১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় । পাকিস্তানি বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়। বিভিন্ন দেশ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে । ২৫শে মার্চের কালরাত্রি এবং পরবর্তী সময়ের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিশ্বজনমত সোচ্চার হয়ে ওঠে । গোটা বিশ্বের জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন জানায় ।
ভারতের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন জানায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত । ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাত্রির বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী ৯ মাস ধরে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী যে নারকীয় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, ভারত তা বিশ্ববাসীর নিকট সার্থকভাবে তুলে ধরে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত করে তোলেন তাঁর নিরলস কর্ম তৎপরতার ভেতর দিয়ে।
ভারতের জনগণ ও সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ‘যৌথ কমান্ড' গঠন করে । ভুটান ও ভারত ৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে । ভারতের বহু সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পর সর্বাধিক অবদান রাখে অধুনা লুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) । পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানান। তিনি ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যও বলেন। সোভিয়েত পত্রপত্রিকা, প্রচার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের কাহিনি ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি প্রচার করে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সহায়তা করে । জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ভেটো' (বিরোধিতা করা) প্রদান করে বাতিল করে দেয় । সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানিসহ তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানায় ।
গ্রেট ব্রিটেন,পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যান্য দেশের ভূমিকা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ব্রিটেনের প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে বিবিসি এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন, প্রতিরোধ, বাঙালিদের সংগ্রাম, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের করুণ অবস্থা, পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্ব জনমতকে জাগ্রত করে তোলে । উল্লেখ্য, লন্ডন ছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের প্রধান কেন্দ্র । ব্রিটেন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার প্রচার মাধ্যমগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করে । ইরাক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানায় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, প্রচার মাধ্যম, কংগ্রেসের অনেক সদস্য এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিল; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, চীন এবং ইরান ও সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। তবে মার্কিন শিল্পী, সাহিত্যিক এবং অনেক রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। পণ্ডিত রবি শংকরের উদ্যোগে আয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানে ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানসহ বিশ্বখ্যাত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ জোগানের ব্যবস্থা হয়।
জাতিসংঘের ভূমিকা : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান যখন বাঙালি নিধনে তৎপর, তখন জাতিসংঘ বলতে গেলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে । নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি ।